করোনার পরীক্ষায় চরম দুর্ভোগ
করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষার ব্যবস্থা চাহিদার তুলনায় খুবই সীমিত। পরীক্ষা করতে নমুনা সংগ্রহের জন্য রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল কিংবা বাসাবাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে থাকা লোকজন আইইডিসিআরের হটলাইনে বা নির্ধারিত নম্বরে ফোন করে নমুনা সংগ্রহের অনুরোধ জানাচ্ছে। অপরপ্রান্ত থেকে বলা হচ্ছে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আপনার কাছে হাজির হয়ে যাবে নমুনা সংগ্রহের জন্য। আপনি প্রস্তুত থাকুন। কিন্তু দুই-তিন দিন অতিবাহিত হলেও নমুনা সংগ্রহের জন্য কেউ আসে না।
অপরদিকে আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে নমুনা সংগ্রহ করার পর তিন থেকে চার দিন বা কোনো কোনো সময় পাঁচ দিন পরও ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এ সময়ে আক্রান্ত ব্যক্তি আরো অনেককে সংক্রমিত করছে। আইইডিসিআরের নমুনা পরীক্ষা ও ফলাফল পাওয়া নিয়ে হযবরল অবস্থা চলছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই নমুনা সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আইইডিসিআর শুধু পরীক্ষা করবে। অন্যদিকে যেসব জায়গায় পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেখানেও চাহিদা অনুযায়ী কিট সরবরাহ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
এ অবস্থার কারণে বিপদ বাড়ছে জানিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, পরীক্ষার ক্ষেত্রে আইইডিসিআরের অবস্থা মহাসমুদ্রের মধ্যে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানির মতো। মে মাস বাংলাদেশের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ মাস। এই মাসেই কয়েক গুণ সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। দ্রুত করোনা শনাক্তের পরীক্ষাকেন্দ্র বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, সারাদেশে ৩৬টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পরীক্ষা চালু করতে হবে। একই সঙ্গে বেসরকারি যেসব হাসপাতালে পিসিআর মেশিন আছে, সেসব হাসপাতালেও পরীক্ষা দ্রুত চালু করতে হবে। আর হেলথ কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্যাম্পল সংগ্রহ করে পার্শ্ববর্তী মেডিক্যাল কলেজে পরীক্ষা করতে হবে। পরীক্ষার মাধ্যমে যত বেশি শনাক্ত করা যাবে, তত বেশি পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। না হলে করোনায় লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন।
আগামী সপ্তাহ থেকে আইইডিসিআরের পরিবর্তে নমুনা সংগ্রহ করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমানে ৩০টি ল্যাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। আরো ২০টি ল্যাব চালু করা হবে। পরীক্ষার পরিধি বাড়ানোর মাধ্যমে আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রতিদিন ১০ হাজার পরীক্ষা করা হবে। প্রসঙ্গত, দেশে কোভিড-১৯-এর প্রকোপ বাড়তে থাকায় পরীক্ষার আওতা বাড়ানোর জন্য প্রথমবারের মতো চারটি বেসরকারি হাসপাতালকে করোনা ভাইরাস পরীক্ষা এবং চিকিত্সার অনুমতি দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতাল (সাবেক এ্যাপোলো), স্কয়ার হাসপাতাল ও ইউনাইটেড হাসপাতাল শুধু তাদের ভর্তি রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করবে। আর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ইউএস-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বাইরের রোগীদের নমুনাও পরীক্ষা করতে পারবে।
একজন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক বলেন, গাধা জল খায় পানি ঘোলা করে। পরীক্ষাকেন্দ্র আরো আগেই বাড়ানো উচিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ব্যাপকভিত্তিক করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করতে হবে। পরীক্ষার মাধ্যমে এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক প্রোভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন বলেন, পরীক্ষার পরিধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে শুরুতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একগুঁয়েমি ছিল। আইইডিসিআর মনে করেছিল, তারা একাই সামাল দিতে পারবে, তারা ছাড়া আর কেউ পরীক্ষা করতে পারবে না। তিনি বলেন, পরীক্ষার পরিধি বাড়ানোর বিকল্প নেই।
বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণ রোধে সঠিক পথে হাঁটছে কি না? যেখানে প্রথম দিকে শুরুতে করোনা নিয়ে গুরুত্ব না দিলেও এখন আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ব্যাপকহারে করোনা পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত করছে, সেখানে বাংলাদেশে যাচাই-বাছাই করে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত সঠিক হচ্ছে কি না? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিঙ্গাপুরসহ যেসব দেশ এরই মধ্যে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাফল্য দেখছে সেসব দেশে কোথাও কাউকে সন্দেহ হলেই গণহারে টেস্ট করা হচ্ছে। এমনকি গোয়েন্দাগিরি করেও সন্দেহভাজনকে টেস্ট করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর উলটো চিত্র দেখায় জনমনে ব্যাপক উদ্বেগ ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ অবশ্যই বাড়াতে হবে। এত অল্প পরিমাণ পরীক্ষা করে দেশে করোনার বিস্তৃতি কতটা, তা বোঝা অসম্ভব। মে মাস বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে একাধিক মাইক্রোবায়োলজিস্ট ও ভাইরোলজিস্ট বলেন, এই মাসে লক্ষাধিক মানুষের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা এবং একই হারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে পারে। প্রত্যেকেই বলছেন, করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা অবশ্যই বাড়াতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক ভিসি ও ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা বাড়াতেই হবে। পরীক্ষা করা না হলে কার দেহে ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে সেটি জানা যাবে না। এতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, করোনার সংক্রমণ যাদের মধ্যে রয়েছে, তাদের শনাক্ত করতে দেরি হলে এবং আক্রান্তদের আইসোলেশনে চিকিত্সাসেবা দেওয়া না হলে সংক্রমণ ছড়াতেই থাকবে। পরবর্তীকালে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব, তাদের শনাক্তকরণের জন্য পরীক্ষার আওতায় আনা দরকার।
জার্নাল বাংলা/সাইফুল